কোয়ার্টার ফাইনালের চার ম্যাচ ও কিছু কথা…

1104

Kamrul Hasan Nasimকামরুল হাসান নাসিম

দৃষ্টি এখন বিশ্বকাপের চার কোয়ার্টার ফাইনালের দিকে। বাংলাদেশে বিশ্বকাপের জ্বর খানিকটা কমে গেছে বলে অনেকেই সায় দিলেও ফুটবলের নিউক্লিয়াস ব্রাজিল ভক্তরা তা মানতে নারাজ। তাঁরা বলছে, সব কিছু কক্ষপথে আছে।

এদিকে দুর্বল আর্জেন্টিনা, ২০১৪ সালের বিশ্বজয়ী দেশ ও চারবারের বিশ্বকাপ জয়ী জার্মানি এবং এবারের আসরের সত্যিকারের শক্তিশালী পর্তুগাল ও স্পেন বিদায় নেয়ার পরেই অনেকে বলছেন, এই বিশ্বকাপ বড় পানসে ! উপরন্ত কোটাগত কারণে ইটালি, চিলি ও হল্যান্ড সহ ইউরোপের সেরা দেশগুলোর অনুপস্থিতিগত কারণে এই বিশ্বকাপের খেলাগুলো নিয়ে অনেকেই মাততে পারছে না। তবে মাঝারি সারির দেশগুলো এই বিশ্বকাপে খুব ভাল খেলেছে ও খেলছে তা মেনে না নেয়ার যৌক্তিকতা কম।

এদিকে চরাই উতরায় পেরিয়ে পাঁচবারের বিশ্বকাপ জয়ী দেশ ব্রাজিল কী করতে পারে তা নিয়ে তাঁদের অগনিত ভক্তকুলের যেন স্বপ্নটা ক্রমেই বড় হচ্ছে। আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর দিয়েগো ম্যারাডোনাও যেন ল্যাটিন ফুটবলের বিজয় দেখার জন্য অপেক্ষারত। তিনি বলছেন, ব্রাজিল রাশিয়া বিশ্বকাপ জিতে যাক। তবে বাস্তবতা হল, ৭ ম্যাচ খেলে সত্যিকার অর্থে বিশ্বকাপ জেতা যায় বৈকি কিন্তু বিশ্বসেরা হওয়া কঠিনই। কারণ, এই ব্রাজিলকে খুব বড় করে দেখার ফলত সুযোগ নেই। চলুন,কোয়ার্টার ফাইনালের চার ম্যাচ নিয়ে আলোচনায় যাওয়া যাক।

প্রথম ম্যাচ; উরুগুয়ে বনাম ফ্রান্স। হয়তো ফ্রান্সের গেল ম্যাচের ফল দেখে অনেকেই বলবেন, এই ম্যাচ জিততে চলেছে তাঁরা। কিন্তু উরুগুয়ে, যারা বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাশিয়াতে এসেছিল তাঁরা খেলার মানের বিচারে যাই হোক— এখনো চার ম্যাচ খেলে প্রত্যেকটি ম্যাচে তাঁরা জিতেছে। যা তাঁরা কখনই করতে সক্ষম নয়, তা করে দেখিয়েছেও। শক্তিশালী পর্তুগালের বিরুদ্ধে খেলার ধারার বিপরীতে দুই দুইটি গোল আদায় করে ক্রিশ্চিয়ানোদের বিদায় করে দিয়েছে। তাঁদের সম্বল জমাট রক্ষনভাগ। আর একজন লুইস সুয়ারেজ। সুয়ারেজ একজন ভাল ফিনিশার হলেও এই বিশ্বকাপে তিনি সাবেক সতীর্থ ফোরলানের কিছু দিক নিজে নিয়েছেন। বল বানিয়ে দিচ্ছেন কাভানীকে এবং নিজেও গোল করার চেষ্টায় থাকছেন। যা প্রথা বিরুদ্ধ কৃষ্টি। সুয়ারেজ অতি ভয়ংকর হয়ে উঠছে। তাঁর একটাই সমস্যা, তা হল খেলার মধ্যে অভিনয় করা। অনেক ক্ষেত্রে সমালোচিত নেইমারের চেয়েও বড় কিছু ! অন্যদিকে এমবাপ্পে কে নিয়ে অনেকেই আশা দেখতে পেলেও এই ম্যাচে তিনি কড়া মারকিং এ থাকবেন। স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারবেন বলে অনুমিত হয় না। বরং গ্রিজম্যানকে ভাল কিছু করতে হবে এবং এই আসরে চরম ফ্লপ তাঁদের নাম্বার নাইন কে আর মাঠে না নামানোই ভাল হবে। এর চেয়ে ডেম্বেলে কে নিয়ে খেললে দেশ্যাম্প বাহিনী ভাল করতে পারবে। আসলে ফ্রান্সে যেমন একজন নেতা দরকার ঠিক তেমনি বেঞ্জেমাকেও দরকার ছিল। তাঁদের পুরোদস্তুর একজন স্ট্রাইকার নেই। যা ভুগাতে পারে তাঁদেরকে। তবে তাঁদের কৃষ্ণাঙ্গ কয়েকজন খেলোয়াড় আছে। রক্ষণে উমটিটি ও ভারানে ভাল করছে। সব মিলিয়ে গডিনেরা আবারো রক্ষণে ভাল করলে তাঁরা ম্যাচটিকে টাইব্রেকারে নিয়ে গেলেই ফল নিজেদের করতে পারবে। সব দিন সমান যায় না। পর্তুগালের বিরুদ্ধে অমন দুই গোল আবারো আসবে তা মনে করার সুযোগ নেই। সঙ্গত কারণে ফ্রান্সই এগিয়ে থাকবে এই ম্যাচে।

j8wcb7kfq94utqfes09pদ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে খেলছে সেই ব্রাজিল বনাম বেলজিয়াম। দুই ‘ব’ এর লড়াই ! দুইটা দলই সাধারণত বল নিজেদের পায়ে রাখতে পছন্দ করে। তবে ব্রাজিল কোচ টিটে এসবের ধার ধারবে বলে মনে করার সুযোগ নেই। তিনি গোলমুখী আন্দোলনে থাকবেন। তা সে যেকোন উপায়েই হোক না কেন। বরং ম্যাচটায় দেখতে হবে বেলজিয়াম কিভাবে তাঁদের মোকাবেলা করে। সারাক্ষণ বল নিয়ে গাধার মত করে ছুটতে থাকা হ্যাজারডেরা আসলে কিছু করতে পারবে বলে মনে করার সুযোগ কম। তাঁদের প্রধান স্ট্রাইকার লুকাকুর নিজস্ব ক্ষমতায় গোল করার দখল নেই। একমাত্র এই দলে তেজস্বী একজন আছেন। যার নাম কেভিন ডি ব্রুয়েন। তিনি কেবল একটা অসাধারণ ভুমিকা রেখে পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন। এখন প্রশ্ন হল বেলজিয়াম রক্ষণ না আগলে রেখে আক্রমণে উঠে ব্রাজিল বধের চিন্তা করলে বড় ব্যবধানে ম্যাচটা হারতে পারে। অন্যদিকে ব্রাজিলকে খুবই কৌশলী ফুটবল খেলতে হবে। তাঁরা গেল ম্যাচে দারুণ খেলে মেক্সিকোকে হারিয়েছে তা মেনে নেয়ার যৌক্তিকতা কম। বরং মেক্সিকো খারাপ ছিল— সে কারণেই সেদিন তাঁরা জিতেছে। শক্তির বিচারে ব্রাজিল মেক্সিকোর চেয়ে বড় মানের ছিল না। নেইমারকে নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। ছেলেটার একটা মাত্র বিবৃতি তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সেটা হল তিনি জানিয়েছেন, সব কিছু নিজেদের মত করে ভাববেন না। আমি ব্রাজিলিয়ান। এটা নেইমার নিজের উপর বিশ্বাস রেখেই বলতে পেরেছেন— যা ইতিবাচক। কারণ, বার্সায় থাকতে অভিনয়ের যে দখলটা তিনি নিয়েছিলেন তা বহুবার বাংলাদেশ থেকে আমি ও ক্রীড়ালোক বলার চেষ্টা করলেও মানুষ তা মানে নাই। এখন মানছে। খেলার চেয়ে অভিনয়টাই সে ভাল করছে। তবে খেলাটাকে স্লো করে দিয়ে পায়ের কিছু স্কিলস দেখিয়ে ব্রাজিলের সাফল্য ঘরে তোলার জন্য নেইমারকে ধন্যবাদও জানাতে হয়। যখন বিদ্যত গতির খেলা চলছে— আর তিনি প্রায় পাঁচ ফুট দূরত্বে প্রতিপক্ষের কাউকে রেখে বল নিয়ে যখন তাঁর সাথে তামাশা করেন সেটাও কম ক্ল্যাসিক নয়— এটাকে শিল্প বলা যায় ! ফুটবলের ব্যকরণে সেটার জায়গা আছে। কারণ, ওই সময়টায় বিপক্ষ দলের ওই খেলোয়াড় কিন্তু বুঝতে পারে না নেইমার কোন দকে বল নিয়ে ছুটবেন তখন ! তবে মানের বিচারে সময়ের নয়, সর্বকালের সেরা দুই গ্রেট রোনালদো ও মেসি থেকে অনেক পিছিয়ে তিনি। তাঁর গোল করার অসীম ক্ষমতা নেই, বল যুগানোর ক্ষেত্রেও তাই। তবে তাঁর নিজের একটা খেলার ধরণ আছে। ব্রাজিলের ইতিহাসে সেটাও নতুন মাত্রা যোগ করে বৈকি ! এদিকে কউটিন হো কে খুব করে ভাল বলার চেষ্টা চলছে। খারাপ না, তবে ব্রাজিলের ধারাবাহিক গ্রেটদের মত না। অন্যদের মধ্যে দলে এক মারসেলো ছাড়া বিশ্বমানের কেও নেই। সঙ্গত কারণেই অযথাই দেখা যেতে পারে যে, ব্রাজিল কোন ম্যাচে ৪/৫ গোল খেয়ে বিদায় নিচ্ছে ! এক টিটে পরপর ৭ ম্যাচে সফল হবেন তাও এমন দুর্বল স্কোয়াড নিয়ে— বিশ্বাস করার মত বিষয় নয় কিন্তু ! ৭ ম্যাচটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে কারণেই আমি সব সময় বলি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য আছে। অবুঝ দর্শক ও মিডিয়া হয়তো বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নকেই বিশ্বসেরা বলতে চায়। আসলে এর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু ? সাধারণদের জন্য বলা ভাল, চার বছর ধরে যে দলটা ফিফা র‍্যাংকিং এ শীর্ষে থাকে তাঁরাই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর চার বছর পরে যে দেশটা ৩২ টা দলের মধ্যে জিতে তাঁরাই বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। সেটা নিয়ে বিস্তারিত লেখা আসছে। বেলজিয়াম আর ব্রাজিল নিয়ে ছিলাম। আমার মনে হয় ব্রাজিল ৩-০ গোলে জিততে চলেছে। আর দুর্বল ব্রাজিলের সেই পচা দিনটি এলে লজ্জাজনক হার এদিনেও আসতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে, বেলজিয়াম বড় দেশ। তাঁরা ১৯৮৬-৯০ সালের দিকে ফুটবলের বড় দেশ হয়ে পড়েছিল।

তৃতীয় ম্যাচে সুইডেন বনাম ইংল্যান্ডের লড়াই। তাঁরা উভয়েই সুন্দর ফুটবল খেলবে না। তবে ইংল্যান্ডের হ্যারি কেইনের মধ্যে নেতৃত্ব ও গোল করার ক্ষুধা দেখতে পেলাম। এর অর্থ এই নয় যে তাঁর প্যানামার বিরুদ্ধে হ্যাট্রিক কে বড় করে দেখছি। আমি বলবো সে কলম্বিয়ার সাথে যে কয়টা চেষ্টা গোলের জন্য নিয়েছে এবং টাইব্রেকারে যাওয়ার পরে তাঁর নিজের পেনাল্টি শট অনেক কিছু কথা বলে। অন্যদিকে এই বিশ্বকাপে ৬০ বছরের পুরোনো ইতিহাস আবার ফেরত না আসে। ১৯৫৮ সালে ব্রাজিল বনাম সুইডেনের সেই ঐতিহাসিক ফাইনাল। ইউরোপ থেকে ল্যাটিনেরা যে একটি কাপ জিতেছিল তা ব্রাজিল পেয়েছিল এই সেই সুইডেনকেই ৫-২ গোলে হারিয়ে। খুব অবাক হব না এমন কিছু হলে। অর্থাৎ সবাইকে বোকা বানিয়ে সুইডেন ফাইনালে ! তবে ইংল্যান্ডকে খুব শক্তিশালী বলার উপলক্ষ আছে, আছে সুইডেনকেও বিপজ্জনক বলার ! এই সেই সুইডেন যারা ইটালিকে বিশ্বকাপে আসতে দেয়নি। তাঁদের ভরাট রক্ষণ এবং সুঠামদেহী খেলোয়ারদের নিয়ে আপনি আগাম মন্তব্য করতে পারবেন না। ব্রোলিন- ডাহলিন- এন্ড্রারসন- লুয়েনবারগ- ইব্রাহামোভিচ দেরকে ছাপিয়ে একটা সুইডেন টিম বদলে দিতে পারে ইতিহাস। তবে ম্যাচটায় কে জিতবে বলা মুশকিল। আমার মনে হচ্ছে আবারো টাইব্রেকারে নিষ্পত্তি হতে যাচ্ছে !

চতুর্থ ম্যাচ রাশিয়া বনাম ক্রোয়েশিয়া মধ্যকার। দুটোই চমক লাগানো দেশ। গেল বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়া তেমন কিছু না করতে পারলেও দেশ স্বাধীনের পর হতে তাঁরা ফুটবলের অদম্য এক দেশ। বোবান ও ডেভর সুকারের হাত ধরে তাঁরা অনেক আগেই জানান দিয়েছিল, আমাদেরকেও তোমরা পরাক্রম বলে জায়গা দাও। যেটা আজ লুকা মড্রিচের নেতৃত্বে পূর্ণতা পেয়েছে। দলের প্রায় সভ খেলোয়াড়দের নামের শেষে ‘চ’ থেকে তাঁরা যেন বলতে চায়, চাবাইয়া খাবো ! খাচ্ছেও তাই। আর্জেন্টিনার বুড়ো হাড় চিবিয়ে তাঁরা এখন স্বাগতিক রাশিয়াকে ঘায়েল করতে চায়। তবে তাঁদের গেল ম্যাচে কাজটা বেশ কঠিনই হয়ে পড়েছিল। টাইব্রেকারে জিতে ভাগ্য পরীক্ষায় বিজয়ী দল। তাতে কী ! স্বাগতিক রাশিয়ার উড়ন্ত সূচনাও এখন ভাগ্যের উপর নির্ধারিত হচ্ছে। তাঁরাও নক আউট রাউন্ডে টাইব্রেকারে জিতেছে। ফিফা ও অশরীরী শক্তি একটু পেছনে থাকলে এই রাশিয়া কোথায় যেয়ে থামে কে জানে ! কাগজে কলমে লুকা-রাকিটেচের ক্রোয়েশিয়া ফেভারিট থাকলেও রাশিয়া সব হিসাব নিকেশ বদলে দিতেই পারে !

লেখক : প্রধান সম্পাদক, ক্রীড়ালোক