কাশ্মীর কাহিনী-১

1980

ঈদের ছুটিতে অনেকেই ঘুরতে যান দেশের বাইরে। বাংলাদেশের খুব কাছাকাছি সুন্দর কোথাও ঘুরতে যেতে চাইলে কাশ্মিরের বিকল্প নেই। পৃথিবীর ভূস্বর্গ হিসেবে খ্যাত কাশ্মিরের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সৌন্দর্য। সম্প্রতি কাশ্মির ঘুরে এসে লিখেছেন কবি ও শিক্ষক স্নিগ্ধা বাউল। 

দক্ষিণ ভারতের সর্বশেষ বিন্দু কণ্যাকুমারী ছুঁয়েই পরিকল্পনায় আসে এরপর কাশ্মীর। জম্মুর রাতের টানটান উত্তেজনা ভোরেই শেষ হয়।এ যাত্রায় আমরা শিমলা থেকে মানালী হয়ে জম্মু পর্যন্ত এসে থেমেছি। এরপর গন্তব্য মূল কাশ্মীর। মূল কাশ্মীর বলছি এজন্য যে স্হানীয় লোকজন জম্মুকে খুব একটা পর্যটনের জন্য ধরেনা ।

এবার আমাদের হাতে সময় তিনদিন। আলোচনা উত্তেজনা আর চলমান ইতিহাসের রাজ্যভ্রমণ আমাদের। বেশ উত্তেজনা আর ঠাণ্ডার মধ্যে সকাল আটটায় আমরা বেরিয়ে যাই হোটেল মেরিডিয়ান, জম্মু থেকে।
বলে রাখছি, আমারও ধারণা ছিল, হয়তো কাশ্মীর ভ্রমণের জন্য আলাদা করে অনুমতি লাগে,,কিচ্ছু না,,একদম সহজ ভারতিয় ভিসায় আমরা উঠে পড়লাম শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে। আজ আমাদের সাথী রশিদ ভাই। বয়স পঞ্চাশের বেশি। কাশ্মীরি পাজামা পাঞ্জাবি কটি আর টুপি গায়ে হাজির রশিদ ভাই। এ পর্যন্ত আমরা যতজন ড্রাইভার পেয়েছি সবাই আমাদের বয়েসী ছিলেন, রশিদ ভাই ব্যতিক্রম এবং শুরু থেকেই উনি আমাদের নিয়ন্ত্রণ উনার হাতে নিয়ে নিলেন। বরাবর ধমকের সুরেই কথা বলছেন তিনি। আমরাও মেনে নিচ্ছি,,কারণ সকাল সকাল ঠাণ্ডায় আমরা কিছু কারণ গলায় ঢেলেই বের হয়েছি। প্রবল উত্তেজনা আর ফুরফুরে মেজাজ।
বললাম রশিদ ভাই ঝিলম দিখানা হামকো,,এরপর যতই নদী আসে উনি বলে উধার ঝিলম,,দেখ দেখ,,,মুসিবত পুরাই।
জম্মু থেকে শ্রীনগর প্রায় সাত আট ঘণ্টার পথ এবং আমাদের পরিকল্পনা যেহেতু পেহেলগাম, রশিদ ভাই সাজেস্ট করলেন আগে পেহেলগাও,,বাদমে শ্রীনগর অর উদার সে দিল্লি যানা,,, আমরাও মেনে নিলাম।

35194283_654367608236393_957764839285981184_nপাহাড়ের বিচিত্র মায়া সকাল সকাল দেখছিলাম জম্মুর আকাশে। জম্মু ছেড়ে আমরা যতই যাচ্ছি কেবল মায়া আর মায়া। রাস্তাগুলো ঠিক কতটা প্রস্হ আমি অনুমান করতে পারছিলাম না। এত স্হির রাস্তা, কখনো শুধু আমাদের গাড়িই,,মনে হলো এই বুঝি গাড়ি কেউ আটকে দিলেন,,,কিন্তু না,,বিশ্বাস করেন এত স্নিগ্ধতা আর শান্তির পথ একেবারেই স্বর্গ। এ পথে শুরু থেকেই আপনি পাবেন ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্হার স্বাদ আর পর্যটনবান্ধব নীতি। থেকে থেকে পাহাড়ের পেট সিজার করে তৈরি করা ট্যানেলগুলো কত কত দূরত্ব কমিয়ে এনেছে তা অনুমানের বাইরে। প্রথম ট্যানেল অতিক্রম করেই আমরা খুব উত্তেজিত,,রশিদ ভাই হাসেন। “আভি বহত বাকি হে মেরি ইয়ার,,,”

আমরা সেই ইন্ডিয়ান এক্সেপ্রেস হাইওয়ে ধরেই চলছিলাম। দশটার পরপর থেমে যাই রাস্তার পাশের এক পাঞ্জাবি ধাবাতে। বলে রাখি ধাবার বিজনেসগুলো আমার দেখায় মনে হয়েছে পাঞ্জাবিরাই বেস্ট। আমরা আয়েস করে যখন খাচ্ছিলাম তখনি এসে থামলো দুটো ফ্যামিলি কার। প্রায় বিশজনের একটা বহর,,গায়ের রঙ, ভাষা আর আমার অভিজ্ঞতা বলে দিলো এরা তামিলনাড়ু থেকে। অনুমান করে আমি কাহিল হলাম এরা কতপথ পাড়ি দিলেন,তবে তাদের আনন্দ দেখে আর ক্লান্ত মনে হলোনা।

আবার শুরু আমাদের যাত্রা। খেয়াল করলাম এই রাস্তাগুলোতে কাজ আর কাজ চলছে । সহজগম্য করার কী দৃঢ় প্রয়াস তাদের। উচুঁ পাহাড়ের মাথায় মেঘের গায়ে ভাসছে বিদ্যুত প্রকল্প। তারগুলো পাহাড় বেয়ে নেমে যাচ্ছে লোকালয়ে। কোথাও বেলে পাহাড়, কোথাও পাথুরে। তবে একটা জিনিস কমন। সেটা হলো জলপাই রঙের টহল। কিছু সময় পরপর এদের দেখতে পাবেন।
ঠিক বারোটার পরপর আমরা একটা ট্যানেলে ঢুকে যাই,,ভাবছিলাম এই বুঝি শেষ হলো।। ও,,মা আলো দেখতে আমাদের গাড়ি সর্বোচ্চ গতি নিয়েও প্রায় এগারো মিনিট সময় নিলো। আমরা পার হয়ে আসি চেনানা- নাসিয়া ট্যানেল।
গাড়ি ছুটে চলছে তো চলছে। কখনও দেখা যায় পাহাড়ের ভাঁজে কিছু লোকালয়।কখনও কেবল পাহাড় আর পাহাড়। রোদ পড়ে আসতে শুরু করলে পাহাড়গুলো পুরো রঙ বদলে নিলো। এ এক আশ্চর্য খেলা। পশ্চিমের আকাশের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আগুনের রঙে যেন তারা সেনাপতি। বীরদর্পে হুঙ্কার করছে রোদের বিপ্রতীপে। কোথাও অন্ধকার গিলে নিলো পাহাড়ের শরীর। ছায়াগুলো ওখানে খেলা করে তমিস্রার মতো। বাঁক ঘুরেই ফুরফুরে আকাশ। তাল বেতাল আমরা ওদের খেলায়।
চারটা নাগাদ থেমে গেলাম চায়ের তৃষ্ণায়। রশিদ ভাই তার পছন্দমতো দোকানে থামলেন। চা ছিল দুর্দান্ত,কিন্তু ওয়াসরুম ভালো ছিলনা, বলতেই রশিদ ভাই গাড়ি থামিয়ে আবার ফেরত গেলেন। ওরা এসে সরি বললো। রশিদ ভাই বোলা,,ইজজত কা সাওয়াল হে,,,
পুরাই ভ্যাবাচ্যাকা আমরা,,

34864832_654367628236391_496817953962983424_nযাচ্ছি পেহেলগাও আমরা। সম্ভবত এটি অনন্তনাগ জেলার অন্তর্গত একটি গ্রাম। এটি অনেক বড় একটি জেলা।
পাঁচটা নাগাদ আমরা নেমে আসি একেবারেই সমতলে। প্রায় ত্রিশ মিনিট গাড়ি সমতল আর লোকালয় ধরে ছুটে চললো। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। রশিদ ভাই আমাদের কই নিয়ে যাচ্ছেন। কিছু সময় বাদে একটা বড় বাজারে আমাদের গাড়িতে রেখেই কিছু না বলে নেমে গেলেন রশিদ ভাই। পুরাই অবাক আমরা। ঘটনা কী। খানিকবাদে ফেরত এলেন একটা প্যাকেট হাতে। কিছু পাকা ফল। জানলাম আমরা অনন্তনাগ বাজারে। এটি এখানকার বিখ্যত ফল। আমরা খাচ্ছিনা দেখে রশিদ ভাই নিজেই শুরু করলেন। এরপর আমরা। অমৃত যেন, পেটেও ক্ষুধা।

অনন্তনাগ বেশ জমজমাট। পুরো এক দফা ট্রাফিক পেরিয়ে আমরা ছুটে চললাম। রশিদ ভাই জানালেন আর হয়তো ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। ছায়ার মতো ঝুপঝাপ অন্ধকার নামতে শুরু করে আবার, সাথে ঝরঝর একটানা মেলোডি।ঝিরিগুলোর একটানা বয়ে চলায় গতিশব্দটা জোনাকের মতোই। ক্লান্তিহীন টানটান যেন ডাকাডাকি। দূর ইতিহাসের নগরীতে আমরা যেন ঢুকে গেলাম টাইম মেশিনের চাকায়।

আমরা প্রায় পৌছে গেলাম পেহেলগাম। তবে শুরুতেই হাতের বাঁ দিকে যে সৌন্দর্য তা চেখে নিবেন। দরকার হলে জোর করে গাড়ি থেকে নামবেন। কারণ এরপর আর এদিকে আসা হবেনা।এখানে ঝর্ণার জলের মাঝে মাঝে রিসোর্ট আছে। তবে সিজনে তা বরফে পরিণত হয়।
সাতটা নাগাদ আমরা পৌছে যাই গন্তব্যে। এখানে হোটেলের চাইতে রিসোর্টে থাকা ভালো। দরদাম করে ঘুরে ফিরে আমরা পেহেলগাম রিসোর্টে উঠে গেলাম।থাকবো দুদিন। রুমে ঢুকে তব্দা।
কাঠের বাড়িটার পেছন থেকে ভেসে আসছে অশরীরী সব শব্দ। ঝর্ণার জলের সাথে পাথর সমেত এ শব্দগুলো আগে কেবল হরর মুভিতেই শুনেছি। মন্দ নয়।

ঠাণ্ডা জল। বলতে গেলে বরফ জল। পেহেলগামে কারেণ্ট নেই, চলছে বনধ্। জ্বলছে পাহাড়। পাহাড়ের আগুন আমরা বারান্দায় বসে দেখছিলাম। রাতে কার্ফিও। সম্ভবত আমরা ছাড়া হাতে গুণা ক’জন পর্যটক।
রিসোর্টে খাবার নেই। বেরিয়ে গেলাম খাবারের সন্ধানে। রশিদ ভাই আছেন এখনও। বললাম খেয়ে যান।
এবার পেয়ে গেলাম সুহৃদ।আমির জিনাত দম্পতি। হোটেল ও রেস্টুরেন্ট চালায় ওরা। পাশাপাশি টুরিস্ট নিয়ে ব্যবসা।
চমৎকার রুটি আর খাসির কাবার খেয়ে যখন বের হলাম রাত নয়টা। রশিদ ভাইকে ছেড়ে দিয়ে আমরা চারজন হাঁটছি। কয়েকটা ছেলে পাশ কেটে চলে গেলো কেমন করে যেন!
অদ্ভুত পোশাকের জন্য আমরা একটু ভয়ই পেলাম। পরে জেনেছি এর নাম ফিরান।

রাতে রুম এবং বেড হিটার নেই। তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি। ভরসা এবার রনির ব্যাগে রাখা পানীয়। অতঃপর রাত দুটা অবধি চার বন্ধুর গল্প চললো ঝর্ণার পাশে বারান্দায়।
তখনও পাহাড়টা দূরে জ্বলছিল দাউ দাউ করে…।

কাশ্মির কাহিনী-২: পেহেলগাও…