কাঁদো যশোর রোড, কাঁদো —বিপ্রদাশ বড়ুয়া

715

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ থেকে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও বিজয় প্রত্যক্ষ করার জীবন্ত সাক্ষী যশোর রোডের প্রপিতামহ বৃক্ষ মহাশয়েরা। চিরকল্যাণকামী এ মহীরুহর কাছে আমরা অশেষ ঋণী, তাই সেগুলোর কাছে বারবার অবনত হই ও ভালোবাসি। কারণ প্রকৃতি ও মানুষ নিগূঢ় অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। ধান, লতাপাতা ও গাছের প্রতিটি চকচকে ডগা, প্রান্তরে জমা মায়াবী কুয়াশা, ঋতুতে ঋতুতে বৃষ্টি, প্রতিটি পতঙ্গ ও পাখি, জীবজন্তুর গুঞ্জন আমাদের অন্তরে ও স্মৃতিতে পবিত্র। মানুষ সবসময় হয়তো তাদের মনে করে না কিন্তু দিন ও রাতের কোনো না কোনো সময় গাছপালা বা তার ফুল-ফল ও হাওয়ার কাছে ফিরে ফিরে যায়। শিল্প ও সাহিত্য, গান ইত্যাদি রচনা করে। বেঁচে থাকা উপভোগ করে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কবি অ্যালেন গিনস্বার্গ যশোর রোড নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন, যা বাঙালি ও বিশ্ববাসীকে আলোড়িত করেছিল। যশোর থেকে এ সড়ক কলকাতা ও গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডে মিশে দিল্লি চলে যায়।

১৭০ বছরের প্রাচীন যশোর রোড বনগাঁ সীমান্তে ২০১১ সালে ছিল মাত্র তিনটি বৃষ্টি শিরীষ (আলবিজিয়া রিচার্ডিয়ানা)। সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হরিদাসপুর গিয়েই একই যশোর রোডের দুই পাশে গায়ে গা-ঘেঁষে আছে সেগুলো। এগুলোই আবার সামিয়ানা বা তোরণের মতো দুই পাশ থেকে বড় বড় ডালপালা মেলে দিয়েছে ছায়া বিছিয়ে। ২০০১ সালের ৮ জানুয়ারি ভোরের কাগজের নিয়মিত কলামে লিখেছিলাম, ‘এপার ও ওপারের পার্থক্য’ শিরোনামে। শুনুন সে কথা, ‘যশোর রোডের পরিচয়বাহক ঐতিহ্যবাহী এই বৃক্ষ সীমান্ত থেকে যশোরের দিকে চার-পাঁচ কি.মি পর্যন্ত গাছ প্রায় উধাও। এরপর ঝিকরগাছা পর্যন্ত এ বৃক্ষ মহাশয়দের গায়ের চামড়া কেটে নম্বর মেরে গোনা হচ্ছে। গাছের জন্য এ গণনা পদ্ধতি খুবই ক্ষতিকর। নম্বর গুনে ৩৫০টি পেলাম। অথচ এখানে থাকা উচিত ছিল অন্তত এক হাজার প্রাচীন বৃষ্টি শিরীষ। মাঝে মাঝে কিছু গাছ মরে গেছে বা কেটে ফেলা হয়েছে।… পশ্চিমবঙ্গের অংশে এ রকম আহত বা বিপর্যস্ত তেমন একটি গাছও আমি দেখিনি। বনগাঁ-হরিদাসপুর সীমান্তে এপার ও ওপারে কত পার্থক্য! এ রকম প্র-প্রপিতামহ বৃক্ষ বাংলাদেশে খুব কমই আছে।’

যশোর রোড যুগোপযোগী করার জন্য যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা রাস্তার দুই ধারের ১৭০ বছরের ঐতিহাসিক বৃক্ষ নিধন করার মত দিয়েছেন, তাদের যোগ্যতা সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ জাগে। আসলে এ অমূল্য মহাবৃক্ষ কাটতে পারলে এর থেকে ঘুষ হিসেবে অনেক অর্থ আসবে বলব না কি! এই ঐতিহাসিক অমূল্য বৃক্ষ নিধন করতে হলে আমার মতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অনুমোদন দরকার। নয়তো ৮-১০ শতাংশ বনভূমিও থাকবে না। যদিও এখন ছয় মাসের জন্য গাছ না কাটতে স্থিতাবস্থা জারি করেছেন হাইকোর্ট।

এখন পশ্চিমবঙ্গের হরিদাসপুর স্থলবন্দরে ঢুকেই দেখতে পাবেন সড়কটির দুই পাশের গাছ অক্ষত রেখে পাশাপাশি সমান্তরালভাবে আরেকটি রাস্তা করেছে। মূল সড়কের বৃক্ষগুলোকে সম্মান জানিয়ে পাশেই নতুন সড়ক নির্মিত হয়েছে। কলকাতা পর্যন্ত এ সড়কের মহীরুহ বৃষ্টি শিরীষ গাছের ডাল প্রায় অক্ষত আছে। মাঝে মাঝে কিছু ডাল কাটা হয়েছে খুব প্রয়োজনে। দেখে বোঝা যায়, তাতে রয়েছে অতি প্রয়োজনের ছাপ।

গাছ রক্ষা করার জন্য ভারতের কিছু অতি সাধারণ মানুষের প্রাণদানের সত্য ঘটনা হলো ‘চিপকো আন্দোলন’। শুনুন তাহলে। ১৭৩১ সালে ভারতের যোধপুরের রাজা তার নতুন রাজপ্রাসাদ নির্মাণের জন্য কাঠুরেদের বনে পাঠালেন। কাঠুরেরা কুঠার দিয়ে বিষ্ণু সম্প্রদায়ের পাশের বনে কাঠ কাঠতে ঢুকল। বিষ্ণুরা সবসময় ওই বনের পশু ও গাছের রক্ষা করত, কাজেই রাজার লোকেরা এতে ভয় পেল।

অমিতা দেবী নামে এক তরুণী মা একটি গাছ আলিঙ্গন করে ধরে রেখে কাঠুরেদের গাছ না কাটার জন্য মিনতি করতে লাগল। তার তিন কন্যাও তাকে অনুকরণ করে তিনটি গাছ দুই হাতে আগলে ধরল। কিন্তু অমিতা দেবী ও তিন মেয়েকে রাজার কাঠুরেরা গাছের সঙ্গে কেটে ফেলল। সন্ধে নামতে নামতে সেই গ্রামের আরো ৩৬৩ জন গাছের জন্য প্রাণ দিল। এ ঘটনা শুনে রাজা অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়ে বিষ্ণুদের পাশের বনের গাছ কাটা নিষিদ্ধ করে দিলেন।

১৯৮৫ সালের দিকে আবার সে রকম একটি ঘটনা ঘটে গেল। উত্তর ভারতের পাহাড়ি বনাঞ্চলে অতিরিক্ত গাছ কাটার ফলে সেখানকার অধিবাসীরা বুঝতে পারল এতে তাদের অশেষ ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। অরণ্যে গাছ নিধনের ফলে তাদের ভূমির মাটি ধুয়ে যাচ্ছে এবং নদীতে ঘন ঘন বান হচ্ছে। তবুও তারা বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে কিছু করে উঠতে পারছে না, কারণ গাছ ব্যবসায়ী ও কোম্পানিগুলো অর্থসম্পদে অত্যন্ত শক্তিশালী, আর তারা নিয়ম অনুযায়ী গাছ কাটার অনুমতি পেয়েছে।

বিষ্ণু সম্প্রদায়ের মতো সেই গ্রামবাসীদেরও জীবন দেয়া ছাড়া আর পথ রইল না। গ্রামের
নারী-পুরুষ মিলে গাছ জড়িয়ে ধরে থেকে গাছ নিধনকারীদের তাড়াতে সক্ষম হলো। এক বছর কেটে গেল। ১৯৭৪ সালে গাছ ব্যবসায়ীরা কোম্পানি বেনি গ্রামের পাশের অরণ্যকে বাছাই করল।

অর্থের বিনিময়ে গ্রামবাসী ও চিপকো আন্দোলনের নেতাকেও বশ করল। কিন্তু বেনি গ্রামের একটি ছোট মেয়ে পাহাড় থেকে নেমে গ্রামে খবর রটিয়ে দিল। গৌরী দেবী নামে এক বিধবা গ্রামের মেয়েদের জড়ো করে একে একে গাছ জড়িয়ে ধরে রইল। ধীরে ধীরে আরো মহিলা এল। অনেক বাগিবতণ্ডার পর গাছ ব্যবসায়ীরা থামল। কলকাতা শহরে লেকসার্কাস অঞ্চলে রাস্তা ও উড়াল পুল বসানোর জন্য গাছ কাটতে গেলে মহিলারা গাছে সিঁদুর দিয়ে জড়িয়ে ধরে আন্দোলন করেছিল বছর দুয়েক আগে। আমরা কি যশোর রোড সম্প্রসারণের নামে ঐতিহাসিক বৃক্ষ রক্ষা করার জন্য তাহলে চিপকো আন্দোলনে নামব? চিপকো আন্দোলনের নারীদের বার্তা নতুন করে পৌঁছে দিতে যাব তাহলে দেশবাসীকে? বাংলাদেশে ১৭০ বয়স্ক আর কয়টি বৃক্ষ মহাশয় আছেন কেউ জানেন কি?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নিসর্গপ্রেমী