একজন শিক্ষক কীভাবে বন্ধু হতে পারেন?

1076

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।।

স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বয়সটা আমাদের সময় ছিল পাঁচ কি ছয়। সেটিই ছিল শুরুর সোপান। আমার ছেলের যখন স্কুলে যাওয়ার বয়স হলো, দেখা গেল, সেটি এগিয়ে এসে চার কি পাঁচে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু কিন্ডারগার্টেন স্কুল তত দিনে চালু হয়ে গেছে, যাতে শুরু করতে হয় প্রাক-প্রথম শ্রেণিতে। এখন তো দেখি প্রি-কিন্ডারগার্টেনের জমানা, তিন বছর বয়সেই শুরু হয় স্কুল। আর কয়েক বছর পর ভালো স্কুলে নাম লেখাতে হবে সন্তান জন্মের পরপরই। অথবা কে জানে, তারও আগে। কিন্তু যে বয়সেই শিশু প্রথম তার স্কুলে পা রাখুক না কেন, তার থাকে অনেক ভয়, বিস্ময়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। পরিবারের সুরক্ষিত, আদর-যত্নে আনন্দঘন একটা পরিসর ছেড়ে তাকে ঢুকতে হয় অনিশ্চিত, অরক্ষিত একটি অঞ্চলে; নিয়ম আর শাসনের একটা ঘেরে। সেখানে প্রায় প্রতিটি মুখ অপরিচিত; তার অভিভাবক হয়ে যিনি সামনে দাঁড়ান, সেই শিক্ষক তার অচেনা। অনেকটা সময় তাকে একটানা কাটাতে হয় একটা অচেনা ঘরে, এর ভেতরে যা যা ঘটে, সেসব তার প্রতিদিনের কাজকর্ম থেকে একেবারে আলাদা।

13307300_10206350835710313_6212405284230703980_nছাত্র–শিক্ষক সম্পর্ক সহজ হলে তা দুজনের জন্যই ভালো। মডেল: রিয়াদ ও বাপ্পিবলেই দেওয়া যায়, সময়টা জীবনের পথে সদ্য পা ফেলা কোনো শিশুর জন্য কঠিন। তবে অনেকে দ্রুতই এই নতুন জীবনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে, কেউ কেউ তা করতে পারে আনন্দের সঙ্গে। তবে তা নির্ভর করে স্কুলের, শ্রেণিকক্ষের পরিবেশের ওপর; সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নেওয়ার দক্ষতার ওপর।
একজন খুদে শিক্ষার্থীর জন্য কাজটি সহজ হয় যখন শিক্ষক একজন বন্ধুর মতো তার সামনে এসে দাঁড়ান। একজন শিক্ষক পারেন অনিশ্চিত, উদ্বিগ্ন ও দুরুদুরু বুকের একদল শিশুকে আনন্দময় সময় উপহার দিতে। যাঁরা পারেন, তাঁদের এই শিশুরা সারা জীবন মনে রাখে। যাঁরা খুব ভালোভাবে পারেন শিশুদের উৎসাহিত করতে, নিজেদের মেলে ধরে উদ্দীপনা দিতে পারেন, তাঁরা হতে পারেন এই শিশুদের রোল মডেল।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কটা কেমন হওয়া উচিত? একবার এক গ্রামের স্কুলের আট-নয় বছরের বেশ কিছু শিশুকে প্রশ্নটা করেছিলাম। উত্তরটা সহজে তারা দিতে পারেনি। কারণ, বলার মতো অনেক কথাই তাদের মনে ছিল। কথা বলতেও স্বাচ্ছন্দ্য পায়নি অনেকে। কিন্তু তারা যা বলল, তা এক কথায় প্রকাশ করলে একটা বিশেষণই সামনে আসে: ‘সুন্দর’ অথবা ‘সবচেয়ে সুন্দর’। এটি হলো একটা আদর্শের কথা। বাস্তব হলো, অনেক শিক্ষকই সেই সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না, সে রকম শিক্ষককে শি13332906_10206350886351579_1678732900589930389_nক্ষার্থীরা ভুলেও যায়। একজন শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীর মনে, স্মৃতিতে একটা জায়গা করে নিতে না পারেন, তাঁর শিক্ষকতা করতে না আসাটাই ভালো।

কেমন শিক্ষক সবচেয়ে সুন্দর ওই সম্পর্কটা গড়তে পারেন? তিনিই পারেন, যাঁর ভেতরে সব শিক্ষার্থীর জন্য আদর-ভালোবাসা থাকে, সহানুভূতি থাকে; যিনি তাদের ইচ্ছাগুলো বুঝতে পারেন, সেগুলোকে সম্মান করেন; যিনি তাদের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা—দুটোই চিহ্নিত করতে পারেন। যত্ন দিয়ে, ধৈর্য দিয়ে তাদের শক্তিকে আরও বাড়াতে এবং সীমাবদ্ধতাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারেন। সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কের কারিগর যে শিক্ষক, তিনি শুধু শিক্ষক নন, বন্ধুও বটে—পথপ্রদর্শক তো বটেই। শাসন তিনিই করতে পারেন, যিনি সোহাগ করতে জানেন। তবে শাসন মানে শরীরকে কষ্ট দেওয়া নয়, শাসন মানে মনকে আঘাত দেওয়া নয় (এ দুটো শাসন নয়, অপরাধ); শাসন হচ্ছে কোনো শিক্ষার্থীর পা হড়কে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে শক্ত হাতে তাকে আবার দাঁড় করিয়ে দেওয়া। কাজটি একজন বন্ধু করলে সেটি শাসন থাকে না। দিন শেষে সে জন্য শিক্ষার্থীর কৃতজ্ঞতাই জমা থাকে।

অনেক শিশুর শুরু-জীবনে অনেক দ্বন্দ্ব থাকে, যেগুলোর উৎপত্তি দারিদ্র্য, অপুষ্টি, ভাঙা পরিবার, আবেগের ঘরে নানা অনুপস্থিতি, শারীরিক অথবা মানসিক কোনো অক্ষমতায়। শিক্ষক যদি ওই শিশুদের এসব দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি দিতে পারেন, নিরন্তর সাহস আর উৎসাহ দিয়ে তাদের চেষ্টা আর আশাটা জাগান এবং একসময় তারা আত্মবিশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তাঁকে আজীবন ভালোবাসা আর সম্মানের আসনে তারা অধিষ্ঠিত রাখবে।

12439033_10205382888192230_4636772313801486184_n
তবে শুধু শুরুর প্রথম সোপানে কেন, শিক্ষার সব সোপানেই তো প্রয়োজন হয় সে রকম শিক্ষককে। একটা সাহায্যের হাত, ভালোবাসার হাত, বিশ্বাসের হাত পেলে স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা অনেক শিক্ষার্থীর জীবনই বদলে যায়। শিক্ষার্থীদের বয়স বাড়ে, তাদের জীবনেও অনেক নতুন দ্বন্দ্ব আর সংকট দেখা দেয়, তাদের চাহিদাও বাড়ে। কিন্তু যদি কোনো শিক্ষক তাদের পাশে এসে দাঁড়ান, তাদের পিঠে একটা হাত রেখে বন্ধুর মতো পরামর্শ, সাহায্য দেন, তাহলে সেসব দ্বন্দ্ব-সংকট অনেকটাই কেটে যায়। পরিবারের আর বন্ধুবান্ধবের বাইরের কেউ যদি একজন শিক্ষার্থীর আপনজন হতে পারেন, তিনি তার শিক্ষক। যে শিক্ষকের সঙ্গে তার সম্পর্ক সবচেয়ে সুন্দর, তিনি মা-বাবার বিকল্পও হতে পারেন।

শিক্ষকতা একাধারে এক কঠিন এবং সহজ পেশার নাম। কঠিন, যদি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দূরত্ব থাকে শিক্ষকের। দূরত্বটা ঘুচলে কাজটা হয় সহজ।

যাঁরা শিক্ষকতাকে সহজ করে তুলতে পারেন, তাঁদের সহায়তার জন্য প্রস্তুত থাকে শিক্ষার্থীরাও। সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কের এটিই বড় একটা ভিত্তি।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মডেল: এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক শায়লা রহমান ও তার শিক্ষার্থীরা