ইজারার কার্যাদেশ না পেলেও বংশাল থানা ছাত্রলীগ সভাপতির টোল আদায়

ব্যাবসায়ীরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগকে কোনো টেন্ডারে না জড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ‘সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে একজন থানার সভাপতি কিভাবে বাজারের দরপত্রে অংশ নেন। থানা ছাত্রলীগের সভাপতি এতো টাকা কোথায় পেলেন? তার এতো টাকার উৎস কি? আয়ের উৎস কি?’

643

ঢাকা: ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের(ডিএসসিসি) আওতাধীন নয়া বাজার নবাব ইউসুফ মার্কেটের কাচা বাজারটি থেকে ১ বছরের জন্য টোল আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয়েছেন বংশাল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান হোসেন জন। তিনি দরপত্রে ১ কোটি ৯৬ লক্ষ টাকা দর দেন। এখনো কার্যাদেশ পাননি তিনি। তবে, জন সিন্ডিকেটের লোকজন গত ১অক্টোবর থেকেই আগের চেয়ে বেশি টোল আদায় করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে ছাত্রলীগের নেতারা বলছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোনো নেতা দরপত্রে অংশ নিতে পারেন না। এমনটা হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ব্যাবসায়ীরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগকে কোনো টেন্ডারে না জড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ‘সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে একজন থানার সভাপতি কিভাবে বাজারের দরপত্রে অংশ নেন। থানা ছাত্রলীগের সভাপতি এতো টাকা কোথায় পেলেন? তার এতো টাকার উৎস কি? আয়ের উৎস কি?’
সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, ডিএসসিসির নয়াবাজার এলাকার নওয়াব ইউসুফ মার্কেটের ভেতরের কাঁচাবাজার থেকে চার বছর ধরে খাস আদায় করা হচ্ছিল। বাজারটি এক বছরের জন্য ইজারা দিতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর দরপত্র আহ্বান করে ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ। দরপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিলো ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুর সাড়ে বারোটা এবং খোলার সময় ছিলো একই দিন আড়াইটায়। ইজারার সরকার নির্ধারিত মূল্য ছিল ১ কোটি ৫৫ লাখ ৮৬ হাজার ৫৪৫ টাকা।

ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চারটি দরপত্র জমা পড়ে। এগুলোর মধ্যে ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিল্লাল শাহের ব্যক্তিগত সহকারী শেখ মো. গোলাম কিবরিয়া ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ৩২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম আহমেদ ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা,স্থানীয় ব্যবসায়ী ওয়াহিদুর রহমান ১ কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও বংশাল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা দর দেন।

সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়া স্বাভাবিত ভাবেই ইমরান হোসেনকে কার্যাদেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কার্যাদেশটি মেয়রের দপ্তরে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

নীতিমালা অনুযায়ী কার‌্যারেশ পাবার আগেই জনকে মূল টাকা বাদে আরও ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর এবং ৫ শতাংশ আয়কর জমা দিতে হবে। সে হিসাবে প্রায় ২ কোটি ৩৫ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে হবে।

একাধিক ব্যাবসায়ী নাম প্রকাশ করার শর্তে জানান, ১ বছরের জন্য বাজারের ইজারা নিয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা দিয়ে। এর সাথে ২০% ভ্যাট ও ট্যাক্স দিতে হবে। সব মিলিয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা ১ বছরে বাজার থেকে তুলতে হবে। এটাকা ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকেই আদায় করা হবে। টোল না বাড়ালে এত টাকা এক বছরে তোলা সম্ভব না।
তাঁরা অতিরিক্ত টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দোকানি বলেছেন, বাজারে সবজি ও মাছের দোকান আছে অন্তত ১৬০ টি। এগুলোর মধ্যে সবজির দোকানের প্রতি টুকরি থেকে দৈনিক ৫০-৭০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। আগে দিতে হতো ৩০ টাকা। একটি সবজির দোকানে চার থেকে ছয়টি টুকরি থাকে। স্থায়ী মাছের টুকরি থেকে ৫০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। আগে নেওয়া হতো ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা করে। ইলিশ মাছের টুকরি থেকে নেয়া হয় ৮০০-১০০০ টাকা। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন অনুমোদিত নকশার বাইরে চলাচলের রাস্তায় অস্থায়ী মাছের বাজার বসিয়ে টোল আদায় করা হচ্ছে। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৭০ এর অধিক টুকরি বসে। শুক্রবারে এই সংখ্যা বাড়ে। প্রতিটি টুকরি থেকে নেওয়া হচ্ছে ৮০০ টাকা। আগে দিতে হতো ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করে।

এছাড়া বাজারের সামনের রাস্তার ফুটপাথ থেকে জনের লোকজন প্রতিদিন ২হাজার এর অধিক টাকা চাড়া তুলে বলে জানা গেছে।
তবে সিটি কর্পোরেশন ও বাজার ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, যেসব বাজার ইজারা দেয়া হয় নি, সেখান থেকে সিটি কর্পোরেশন নিজের লোক দিয়ে খাস টোল আদায় করে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক বাজারে গিয়ে খাস টোল উঠান না। তিনি স্থানীয় লোকজনকে মাসিক চুক্তিতে খাস টোল তোলার দায়িত্ব দিয়ে দেন। স্থানীয়রা ইচ্ছেমত টোল আদায় করে। এতে স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত ও সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ‍উভয়েই লাভবান হন।
জানা গেছে, নবাব ইউসুফ মার্কেটের কাচা বাজারেও এখনো সিটি কর্পোরেশন তাদের লোক দিয়ে খাস টোল আদায় করছে। তবে সরেজমিনে গিয়ে ও ব্যাবসায়ীদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশনের কোন কর্মকর্তা টোল আদায় করতে তারা দেখেন নি। তিনি আসেন না। জনের লোকজন টোল আদায় করছে। ১ মাসের টোল আদায়ের জন্য সিটি কর্পোরেশনের টোল তোলার দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিকে ইমরান হোসেন জন ১৫ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েছেন। সরকারিভাবে ৭ থেক ৮ লাখ টাকা জমা দিয়ে কর্মকর্তারা বাকিগুলো আত্মসাৎ করে বলে অভিযোগ তাদের।
সরেজমিনে এবং খোজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর‌্যন্ত বংশাল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি জনকে কার‌্যাদেশ দেয়া নি সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে । কিন্তু সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হবার পরপরই কাচা বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে জানিয়ে দেয়া হয় যে, বংশাল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান হোসেন জন বাজারের ইজারা পেয়েছেন। সে অনুযায়ী তার লোকজন ১ অক্টোবর থেকে আগের চেয়ে বাড়িয়ে টোল তোলা শুরু করে। খোজে নিয়ে জানা গেছে, ময়না, রনি, ঢোলা কাচা বাজার থেকে প্রতিদিন টোলের টাকা তুলে। কাল্লু মুল ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন। জন এর আপন চাচা কালিম অফিস পরিচালনা করেন। নওয়াব ইউসুফ মার্কেট বনিক সমিতির সভাপতি মো. আজাদ হোসেন জন সিন্ডিকেটের পৃস্টপোষক ।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের নেতাদের দরপত্রে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই কাজে কেউ জড়ালে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান জানান, ২০১৫ সালের দিকে ইমরান হোসেনকে বংশাল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয়েছে। তিনি কোনো দরপত্রে অংশ নিয়েছেন কি না, তা তিনি জানেন না।
কার্যাদেশের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরীন বলেন, সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ইমরান হোসেনকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কার্যাদেশ অনুমোদনের ফাইল মেয়রের দপ্তরে আছে।

কার্যাদেশ দেওয়ার আগেই ইমরানের লোকজন বাজার থেকে টোল আদায় করছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এই অভিযোগ সত্য নয়। খাস টোল সিটি কর্পোরেশনের আদায় করার কথা থাকলেও জনের লোকজন কিকরে টোল আদায় করছে?ইমরানের সহযোগিতায় আমাদের লোকজন খাস আদায় করছেন।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ইমরান হোসেন জন বলেন, দরপত্র আমার নামে জমা দিয়েছি। আমি ১ কোটি ৯৬ লক্ষ টাকা দরপত্র জমা দিয়েছি। এতো দিন যারা বাজার চালিয়েছে তারা আমার সাথে আছে।

কার‌্যাদেশ পাবার আগেই আপনার লোকজন টাকা তুলছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, এখনো সিটি কর্পোরেশন বাজার বুঝিয়ে দেয় নাই। এখন তারাই(সিটি কর্পোরেশন) টাকা তুলতেছে।

‘ছাত্রলীগ কোন টেন্ডারের সাথে যুক্ত হবে না’ এ বিষয়ে তিনি বলেন, ওগুলা ভবন টেন্ডারবাজী, যেগুলো জিম্মি করে করে সেগুলো। এখানে সর্বোচ্চ বিটের(দরদাতার) একটা হিসাব আছে।
এই বাজারটাতে আমার বাপ-দাদা চোদ্দগুষ্ঠির আধিপত্য, উনারা চালায়ে আসছেন। এখন আমার চাচারা চালাচ্ছেন, উনারা ইজারা নিবেন। চাচারা আমার নামে দরপত্র ফেলেছেন। ইনভেস্টও উনাদের। বাজারে আমার চাচাদের অনেক দোকান আছে খোজ নিয়ে দেখেন।

প্রায় ২ কোটি টাকা দিয়ে ইজারা পাচ্ছেন, সাথে ২০% ভ্যাট ট্যাক্স, সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৩ কোটি টাকা তুলতে হবে, এক বছরে এত টাকা উঠানো সম্ভব কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতে তো সরকারের লাভ। আমরাতো কোন সিন্ডিকেট করিনি। যারা চালাবেন, আমার চাচারা ভালো বলতে পারবেন, তারা লস খেতে চায় নাকি লাভ করতে চায়।

আপনি ইজারা পেয়েছেন এমন কথা চাউর আছে, আপনার লোকজন টাকা তুলছে, বেশি টোল আদায় করছে এসব বিষয় তিনি অস্বীকার করে বলেন, খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, কর্পোরেশনের সাথে কথা বলেন। কেউ যদি বলে অাপনি টাকা তুলতেছেন সেটা কি সত্য হবে এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
‘আপনার চাচা কালিম বাজার থেকে টোলের টাকা তুলেন’ এ বিষয়ে জন বলেন, কালিম আমার চাচা হয়।